হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, সুন্নী মুসলমানদের মধ্যকার ওয়াহ্হাবী ফিরক্বাহ্ - যারা পরে আহলে হাদীছ ও সালাফী নাম গ্রহণ করে এবং শিয়া মুসলমানদের মধ্যকার আখবারী ফিরক্বাহর মধ্যে একটা দারুণ মিল; উভয় ফিরক্বাহ্ই ইফররাত্বী (উগ্রবাদী ও চরমপন্থী) এবং নিজেদেরকে ব্যতীত অন্যদেরকে ইসলাম হতে খারিজ গণ্য করে। উভয় ফিরক্বাহ্ই ইজতিহাদের ও মুজতাহিদগণের অনুসরণের ঘোরতর বিরোধিতা করে, বরং হারাম গণ্য করে এবং এ দুই ধারা যথাক্রমে সুন্নী ও শিয়া ধারার হাদীছের অন্ধ অনুসরণ করে, এমনকি কোনো হাদীছ কোরআন মজীদের ও নবী-রাসূলগণের (আ.) শা’নের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও।
আহলে হাদীছ ও সালাফীরা কেবল যে শিয়াদেরকে কাফের বলে গণ্য করে তা নয়, অধিকন্তু বলে, হানাফীরা মুসলমান নয়; কারণ, তারা রাসূলুল্লাহর (ছ্বা.) কথা মানে না, বরং আবূ হানীফাহর কথা মানে। অথচ এই আহলে হাদীছ ও সালাফীরা বুখাারী, মুসলিম প্রভৃতি গ্বায়রে মা‘ছূম্ হাদীছ-সংকলক কর্তৃক গ্বায়রে মা‘ছূম্ রাভীদের দ্বারা বর্ণিত ও ছ্বহীহ্ হিসেবে দাবীকৃত যে কোনো হাদীছের ওপর অন্ধ বিশ্বাস পোষণ করে। অথচ গোয়ালামাত্রই যেভাবে তার সরবরাহকৃত দুধকে শতকরা একশ’ ভাগ খাঁটি বলে দাবী করে ঠিক সেভাবেই যে কোনো রাভী ও সংকলক তাঁর বর্ণিত হাদীছকে শতকরা একশ’ ভাগ ছ্বহীহ্ বলে দাবী করেন - এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং রাসূলুল্লাহর (ছ্বা.) কথা, আচরণ বা অনুমোদন ও বিরোধিতা বলে দাবীকৃত সুন্নী ধারার হাদীছ-গ্রন্থাবলীর যে কোনো হাদীছেরই রাসূলুল্লাহর (ছ্বা.) কথা, আচরণ বা অনুমোদন ও বিরোধিতা হওয়া অপরিহার্য নয় বিধায় যে কোনো হাদীছকেই অকাট্য দ্বীনী জ্ঞানসূত্রের মানদণ্ডে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গ্রহণ-বর্জন করা অপরিহার্য, কিন্তু আহলে হাদীছ ও সালাফী তথা ওয়াহ্হাাবীরা তাতে রাযী নয়। তাই হানাফীরা যদি এটা বলে তো ভুল বলা হবে না যে, ওয়াহ্হাবীরা (আহলে হাদীছ ও সালাফীরা) মুসলমান নয়, কারণ, তারা আল্লাহ্ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহর (ছ্বা.) কথা মানে না, বরং অন্ধের মতো বুখাারী, মুসলিম প্রমুখের কথা মানে।
একইভাবে আখবাারী শিয়ারা সুন্নীদেরকে তো মুসলমান বলে গণ্য করেই না, অধিকন্তু তারা ইজতিহাদ্ ও মুজতাহিদের অনুসরণকারী উছূলী ধারার শিয়াদের সম্পর্কে বলে যে, তারা মুসলমান নয়, কারণ, তারা গ্বায়রে মা‘ছূমের তাক্বলীদ (অনুসরণ) করে। আখবারীরা গ্বায়রে মা‘ছূমের তাক্বলীদকে হারাম বলে দাবী করে, শুধু তা-ই নয়, তাদের অনেকে যারা গ্বায়রে মা‘ছূমের তাক্বলীদ করে তাদের ওপর লা‘নত্ বর্ষণ করে। অথচ তারা কুলাইনী প্রমুখ গ্বায়রে মা‘ছূম্ হাদীছ-সংকলক কর্তৃক গ্বায়রে মা‘ছূম্ রাাভীদের দ্বারা বর্ণিত ও ছ্বহীহ্ হিসেবে দাবীকৃত হাদীছসমূহের ওপর অন্ধ বিশ্বাস পোষণ করে। অথচ গোয়ালামাত্রই যেভাবে তার সরবরাহকৃত দুধকে শতকরা একশ’ ভাগ খাঁটি বলে দাবী করে, ঠিক সেভাবেই যে কোনো রাভী ও সংকলক তাঁর বর্ণিত হাদীছকে শতকরা একশ’ ভাগ ছ্বহীহ্ বলে দাবী করেন - এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বা.) সহ চৌদ্দ মা‘ছূমের (আ.) কথা, আচরণ বা অনুমোদন ও বিরোধিতা বলে দাবীকৃত শিয়া ধারার হাদীছ-গ্রন্থাবলীর যে কোনো হাদীছেরই মা‘ছূমগণের (‘আ.) কথা, আচরণ বা অনুমোদন ও বিরোধিতা হওয়া অপরিহার্য নয় বিধায় যে কোনো হাদীছকেই অকাট্য দ্বীনী জ্ঞানসূত্রের মানদণ্ডে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গ্রহণ-বর্জন করা অপরিহার্য, কিন্তু আখবারীরা তা করতে কিছুতেই রাজী নয়। তাই উছূলী শিয়ারা যদি এটা বলে তো ভুল হবে না যে, আখবাারীরা মুসলমান নয়, কারণ, তারা কুলাইনী প্রমুখ হাদীছ-সংকলকগণের ওপর এবং তাঁরা যে রাভীদের থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন তাঁদেরকে মা‘ছূম গণ্য করে তাঁদের অন্ধ অনুসরণ (তাক্বলীদ) করে চলেছে। আর পরিহাসের ব্যাপার এই যে, অন্ততঃ বাংলাভাষী আখবাারী শিয়াদের মধ্যে সবচেয়ে কট্টর ইফরাত্বী ফত্ওয়াবাজীতে লিপ্ত দেখা যায় এমন কতক ব্যক্তিকে যারা অতীতে ইফরাত্বী ওয়াহ্হাবী ছিলো; এরা আগে একটি ইফরাত্বী ধারার অনুসারী ছিল এবং পরে তার বিপরীত আরেকটি ইফররাত্বী ধারার অনুসারী হয়েছে।
অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে যে কোনো ইফররাত্বী মত-পথ-চিন্তাধারাই পরিত্যাজ্য। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন:
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا.
“এভাবেই, আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যমপন্থী উম্মাহ্ বানিয়েছি যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য শাহীদ্ (সত্যের সাক্ষী/ দ্বীনের মূর্ত প্রতীক) হও এবং রাসূল তোমাদের জন্য শাহীদ (সত্যের সাক্ষী/ দ্বীনের মূর্ত প্রতীক) হন।” [সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ১৪৩]
সুতরাং মধ্যম পন্থাই প্রকৃত ইসলামী পন্থা। ইসলামের গোটা আদর্শিক কঠামোই এই মধ্যমপন্থী নীতির ওপর ভিত্তিশীল। এ কারণেই, আল্লাহ্ তা‘আলা যেহেতু তাঁর বান্দাহদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত সেহেতু তিনি তাঁর দ্বীনে যথেষ্ট প্রশস্ততা নিহিত রেখেছেন এবং যাদের জন্য যে বিষয়ে ইতমামে হুজ্জাত্ হয়নি তাদেরকে সে বিষয়ের দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন:
لا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلا وُسْعَهَا لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ
“আল্লাহ্ কাউকে তার সাধ্যের আওতাধীন ব্যতীত দায়িত্ব প্রদান করেন না; সে যা কিছু (ভালো) অর্জন করেছে তার জন্য (প্রতিদান) তা-ই রয়েছে এবং সে যা কিছু (মন্দ) অর্জন করেছে তার ওপর (প্রতিদান হিসেবে) তা-ই আপতিত হবে।” [সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ২৮৬]
এই সাধ্যের ন্যূনতম আওতা কতোটুকু?
যেহেতু অনাদি-অনন্ত ইন্দ্রিয়াতীত পরম জ্ঞানময় সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও একত্ব এবং মরণোত্তর জীবনের শাস্তি ও পুরষ্কারের সম্ভাবনার, বরং অপরিহার্যতার জ্ঞান মানুষের মধ্যে সহজাত এবং সে সহজাত জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্)-এর দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ করণীয় ও বর্জনীয়সমূহ নির্ণয় করতে সক্ষম সেহেতু (নবুওয়াতের ব্যাপারে ইতমামে হুজ্জাত্ হয়নি এমন) যে কেউ তাওহীদ ও আখেরাতে ঈমান পোষণ করে এবং সহজাত জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্)-এর রায় অনুযায়ী যথাযথ কর্ম সম্পাদন করে সে-ই নাজাত লাভ করবে [সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ২-৩ ও ৫ এবং ৬২]
এখানে নবুওয়াতের ওপর ঈমানকে শর্ত করা হয়নি, কারণ নবুওয়াতের দাও‘আত্ সঠিকভাবে না পাওয়ার বা নবী-রাসূল সম্পর্কে ভুল পরিচয় পাওয়ার কারণে কারো জন্য এ ব্যাপারে ইতমাামে হুজ্জাত্ না-ও হতে পারে। কিন্তু যার জন্য নবুওয়াত ও কোরআন মজীদের ঐশিতার ব্যাপারে ইতমামে হুজ্জাত্ হয়েছে তার জন্য অবশ্যই এর প্রতি ঈমান ও এর অনুসরণ অপরিহার্য; নচেৎ তা নিফাক্ব বলে গণ্য হবে। আর যার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বা.) ও কোরআন মজীদের ঐশিতার ব্যাপারে ইতমামে হুজ্জাত্ হয়েছে তার জন্য চারটি অকাট্য জ্ঞানসূত্র অনুসরণ অপরিহার্য, তা হচ্ছে: ‘আক্বল্, কোরআন মজীদ এবং অকাট্যভাবে প্রমাণিত রাসূলুল্লাহর (ছ্বা.) কথা, কাজ ও অনুমোদন/বিরোধিতা- যা প্রতিটি বর্ণনাস্তরে ইয়াক্বীন সৃষ্টিকারী ব্যাপক সূত্রে বর্ণিত মুতাওয়াতির্ হাদীছ ও শুরু থেকে শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত সর্বসম্মত মত ও ‘আমল (ইজমা‘এ উম্মাহ্)- যা নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহর (ছ্বা.) মত ও ‘আমলের উদ্ঘাটনকারী। শিয়া-সুন্নী উভয় ধারার খাবারে ওয়াহেদ হাদীছ কেবল এ চার অকাট্য জ্ঞানসূত্রের কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া সাপেক্ষে প্রায়োগিক ও গৌণ বিষয়াদিতে গ্রহণযোগ্য।
নবুওয়াতের ঈমানের বিষয়টি যেমন ইতমামে হুজ্জাত হওয়ার শর্তাধীন ঠিক সেভাবেই মুসলমানদের জন্য রাসূলুল্লাহর (ছ্বা.) স্থলাভিষিক্ত হিসেবে তাঁর আহলে বাইতের ধারাবাহিকতার ইমামগণের (‘আ.) ইমামতের ‘আক্বীদাহ্-ও ইতমাামে হুজ্জাত হওয়ার শর্তাধীন। সুতরাং, কোনো মুসলমানের জন্য এ ব্যাপারে ইতমাামে হুজ্জাত্ না হয়ে থাকলে এ ব্যাপারে তার কোনো দায়িত্ব নেই, কিন্তু ইতমাামে হুজ্জাত হওয়া সত্ত্বেও গ্রহণ না করলে তা হবে নিফাক্বের পরিচায়ক। আর মা‘ছূমগণের (‘আ.) নামে বর্ণিত হাদীছ সম্পর্কে আগেই যেমন বলেছি, যেহেতু রাভীগণ ও সংকলকগণ মা‘ছূম্ ছিলেন না সেহেতু চার অকাট্য দলীলের কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া সাপেক্ষে তা প্রায়োগিক ও গৌণ বিষয়ে গ্রহণযোগ্য।
এরপর আসে তাক্বলীদ প্রসঙ্গ। যে সব মুসলমান পুরো কোরআন মজীদের জ্ঞান রাখে না এবং চার অকাট্য দলীলের আলোকে হাদীছ পরীক্ষা-নিরীক্ষার যোগ্যতা রাখে না তাদের জন্য মা‘ছূম্ ইমামের (আ.) সাক্ষাৎ না পাওয়া অবস্থায় এতদ্বিষয়ক বিশেষজ্ঞগণের (মুজতাহিদগণের) অনুসরণ ব্যতীত গত্যন্তর নেই। এ কারণেই সমাজে এ ধরনের দ্বীন-বিশেষজ্ঞ থাকা অপরিহার্য। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন:
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ.
“মু’মিনদের জন্য সকলের একযোগে (যুদ্ধের উদ্দেশ্যে) বেরিয়ে পড়া উচিত হয়নি; কেন এমন হলো না যে, তাদের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কিছু লোক দ্বীনে গভীর সমঝের অধিকারী হবার (জ্ঞনার্জনের) জন্য বেরিয়ে পড়বে- যাতে তারা যখন তাদের ক্বাওমের কাছে ফিরে আসবে তখন তাদেরকে সতর্ক করতে পারে; তাহলে হয়তো তারা (তাদের প্রকৃত ক্ষতির বিষয়গুলো) পরিহার করে চলবে।” [সূরাহ্ আত্-তাওবাহ্: ১২২]
আর গ্বায়রে মা‘ছূমের তাক্বলীদ্ সম্পর্কেও কোরআন মজীদে আভাস দেয়া হয়েছে; মু’মিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে এরশাদ হয়েছে :
الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ وَأُولَئِكَ هُمْ أُولُو الألْبَابِ.
“যারা (অভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন) কথা শ্রবণ করে, অতঃপর তার মধ্য থেকে যা সর্বোত্তম তা অনুসরণ করে। এরাই হচ্ছে তারা যাদেরকে আল্লাহ্ হেদায়াত করেছেন এবং এরাই প্রকৃত বুদ্ধিমান।” [সূরাহ্ আয্-যুমার্: ১৮]
লেখক: জনাব নূর হোসাইন মাজিদী (বিশিষ্ট ইসলামি গবেষক ও লেখক)